১০০-১৫০ শব্দের মধ্যে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর লেখো। এরপর সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে তোমার উত্তর সংশোধন করো।
১। 'অলিখিত উপাখ্যান' গল্পটি কোন সময়ের ও কোন প্রেক্ষাপটে লেখা?
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
২। গল্পে উপনিবেশবাদী কারা? তারা কীভাবে স্থানীয় মানুষের উপর অত্যাচার করেছে?
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
৩। 'বড়ো বড়ো গাছ কুড়ালের ক্রমাগত আঘাতে প্রাচীন ডাইনোসরের মতো আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ছে।'- আলোচনা করো।
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
৪। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়?
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
সেলিনা হোসেন (জন্ম ১৯৪৭) বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে 'পোকামাকড়ের ঘরবসতি', 'যাপিত জীবন', 'যুদ্ধ', 'গায়ত্রী সন্ধ্যা', 'মানুষটি' ইত্যাদি। নিচের গল্পটি লেখকের 'আকাশপরি' উপন্যাসের অংশবিশেষ।
আকাশপরি
সেলিনা হোসেন
মেয়েটি মায়ের কপালে হাত রেখে আলতো স্বরে ডাকে, ওঠো। আর কত ঘুমুবে।
মা ভীষন আদরের অনুভবে পাশ ফিরে শোয়। মেয়েটি আবার ডাকে। বলে, ওঠো ভোর হয়েছে। ভোরের আলো দেখবে না? তুমি না ভোরের আলো ভীষণ ভালোবাসো।
-হ্যাঁ, ভীষন ভালোবাসি। আমি ভোরের আলো দেখব। রোজ ভোরেই তো দেখতে চাই। কিন্তু হয়ে ওঠে না।
-ছাদে এসো। আমি যাচ্ছি।
মা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। কিন্তু পাশে কেউ নেই। কে ডাকল তাকে? মা চোখ মুছে চারদিকে তাকায়। কেউ কোথাও নেই। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যায়, কে তাকে ডেকেছে। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদে উঠে আসে।
-বাহু, কী অপূর্ব আলো। রিখ, নরম।
মা নিজেকে বলে। মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে।
মা চারদিকে তাকায়। বলে, আমি তো ঐ আলোর ভেতর তোমাকে দেখতে পাই। তুমি কি আছ?
মেয়েটি কথা বলে না। স্নিগ্ধ বাতাস মাকে ছুঁয়ে যায়। মা দুহাতে মুখ ঢাকে। তার চোখ দিয়ে জল গড়ায়।
-কেঁদো না। মেয়েটির কণ্ঠ।
-এভাবে ছুঁয়ে গেলে তো হবে না। আমি তো তোমাকে দেখতে চাই।
-আমি এভাবেই তোমার কাছে থাকি। আমি তো জানি তুমি টের পাও কখন আমি তোমার পাশে এসে দাঁড়াই।
-পাই, পাই।
মা চোখ মুছতে মুছতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। মাঝে মাঝে চোখের ওপর রেগে যায় সে, এত জল কোখা থেকে আসে এই চোখে। জল ফুরোয় না কেন? এসব ভাবলে জল আরো দ্বিগুণ বেগে বের হয়। মেয়েটা তখন কড়া স্বরে ধমক দিয়ে বলে, তুমি এত ফ্যাঁচফ্যাঁচ করো কেন বলো তো। মায়ের কণ্ঠে উত্তর নেই। মা উত্তর দিতে জানে না। মা কান্নার বেগ সামলানোর জন্য রেলিং ধরে ঝুঁকে থাকে।
তখন বাড়ির সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। যে যার কাজে যাবার জন্য রেডি হবে। মায়েরও এখন অনেক কাজ। সবাইকে নাশতা দিতে হবে। নিজের অফিসে যেতে হবে। যাবার পথে শিশু হাসপাতালে যেতে হবে তপুকে দেখতে। ওর ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। এটা নিয়ে মা ভীষণ চিন্তায় আছে। যদিও ডাক্তার বলেছে, তপু বিপদমুক্ত, কিন্তু মায়ের ভাবনা কাটে না।
মা চোখের জল মুছে রান্নাঘরে যায়। চটপট অনেকগুলো স্যান্ডউইচ বানায়। ঘড়ি দেখে। স্যান্ডউইচের প্লেটটা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে যাবার সময়ে থমকে দাঁড়ায় মা। বুক ভেঙে যায়। টেবিলের একটি চেয়ারে মেয়েটি আর এসে বসে না। ঐ একটি চেয়ার ওর প্রিয় জায়গা ছিল। ওই চেয়ারটিতে না বসলে নাকি ওর ভাত খাওয়া হতো না। এখন কোন চেয়ারে বসে ও ভাত খায়? এই ভাবনার মাকে মা স্যান্ডউইচের প্লেট হাতে নিয়ে হাবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় যেন চেয়ারটার একটি পা নেই।
যেন পা-হীন চেয়ারটাকে কেউ সুইরজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের জাতিসংঘ দপ্তরের ভবনগুলোর সামনে রেখে দিয়েছে। মায়ের মনে হয়, সে তার মেয়েটিকে নিয়ে সেই ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে মিলে হাঁ করে বিশাল চেয়ারটাকে দেখছে।
মায়ের কানে মেয়েটির কণ্ঠ বাজে, কী ভাবছ না?
-তুমি আর আমি সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলাম, সে কথা মনে পড়ছে
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে। মায়ের কানে সে হাসি বড়ো মধুর লাগে। মা বুঝতেই পারে না যে অন্য ঘরে এষা ওর বাবার সঙ্গে মজা করছে আর হেসে গড়িয়ে পড়ছে। মায়ের মনে হয় চেয়ারটা দেখতে দেখতে সে শক্ত করে মেয়েটির হাত চেপে ধরেছে। মেয়েটি একদিন ওকে বলেছিল, জানো মা আমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ভীষণ মূল্যবান। আমার একটি পা না থাকলে আমি আর প্লেন চালাতে পারব না।
মেয়েটি আবার বলে, তুমি ঐ চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে আছো কেন আমি জানি।
-জানবেই তো। তুমি তো আমাকে বলেছ ভূমিমাইন নিষিদ্ধ করার আন্দোলন শুরু হয়েছে। কারণ যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরও পেতে রাখা তুমিমাইন বিস্ফোরণে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে কিংবা পঙ্গু হচ্ছে। এই বিশাল চেয়ারটি ভূমিমাইন পেতে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। শুধু তাই নয়, এটা রাখা হয়েছে তাদের সারণে যারা ভূমিমাইন বিস্ফোরণে মরে গেছে কিংবা পঙ্গু হয়েছে। কারা যেন স্লোগান দিচ্ছে 'মাইনমুক্ত পৃথিবীর জন্য লড়ে যেতে চাই।'
মায়ের মনে হয় সে ওই স্লোগানটি শুনতে পাচ্ছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটিও স্লোগান দিচ্ছে। অনেকক্ষণ চেঁচিয়ে মেয়েটি বলে, তুমি স্লোগানটি দিচ্ছ না কেন মা?
-তোমার কণ্ঠ শুনতে আমার ভালো লাগছে। স্লোগানটি দেওয়ার সময়ে তুমি যে অন্যরকম হয়ে যাও তা দেখতে আমার ভালো লাগছে। আমাকে দেখতে দাও।
-ঠিক আছে দেখো, কিন্তু আমি যখন এই পৃথিবীতে থাকব না, তখন কিন্তু তুমি আমার হয়ে স্লোগানটি দিও।
মা আঁতকে উঠে বলে, না, এমন কথা বলবে না। তুমি থাকবে না কেন?
-আমি তো আকাশপরি হয়ে যাবো মা। তখন দূর থেকে দেখব পৃথিবী নাইনমুক্ত হয়েছে। ঘটে যাওয়া যুদ্ধের পরেও পেতে রাখা মাইনের কারণে কেউ হারাচ্ছে পা, কিংবা জীবন।
-এসব কী বলছ তুমি? তখন আমি তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে পারব তো?
-ছোটোবেলা থেকে কত না পরির গল্প শুনেছো তাকে কি ছুঁয়ে দেখতে পেরেছ?
-ওহ্মাগো, আমি চাই না এমন দিন আমার জীবনে আসুক। আমি তোমাকে বুকের মধ্যে ধরে রাখতে চাই।
মায়ের শরীর থরথর করে কাঁপে। হাত থেকে পড়ে যায় স্যান্ডউইচের থালা।
ছুটে আসে এখা আর ওর বাবা।
-কী হয়েছে তোমার?
মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কথা বলে না। তারপর চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ওরা মাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
মা বিকেলে তপুকে দেখতে শিশু হাসপাতালে যায়। তপু মায়ের বান্ধবীর ছেলে। গিয়ে দেখে তপুর বিছানা শূন্য। ওখানে অন্য রোগী। মা ভাবে, তপু বোধহয় ভালো হয়ে বাড়ি চলে গেছে। না ওয়ার্ডের চারদিকে তাকায়। দিনের বেলায়ও ডেঙ্গু জ্বরে অসুস্থ বাচ্চাদের মশারির ভেতরে রাখা হয়েছে। কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে হাসপাতালের
ওয়ার্ড। মাকে ওই বেডের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশের বেডের মহিলা জিজ্ঞেস করে, আপনি কাউকে খুঁজছেন?
-হ্যাঁ, এই বেডে তপু নামে একটা বাচ্চা ছিল।
-ঘণ্টা দুয়েক আগে ও মারা গেছে।
-মারা গেছে?
মায়ের মাথা ঘুরে উঠলে কিছু একটা ধরার জন্যে হাত বাড়ায়। তখন সেই মহিলা তাড়াতাড়ি মাকে ধরে ফেলে।
টুল টেনে বসতে দেয়। বলে, কিছুক্ষণ আগে সবাই লাশ নিয়ে বাড়ি গেছে।
মা কথা বলতে পারে না। মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মহিলা জিজ্ঞেস করে, রোগী আপনার কী হয়?
-বান্ধবীর ছেলে।
-এখন আপনার বান্ধবীর ব্যড়িতে যাবেন?
-যাব। যেতেই তো হবে। তারপর দ্রুত মাথা নেড়ে বলে, না, না, যাব না।
-কেন যাবেন না?
-এখন কেউ মারা গেলে সেখানে আর আমি যেতে পারি না।
-কেন?
-আমার মেয়েটি যে আকাশপরি হয়েছে।
-মানে? মহিলা অবাক হয়ে তাকায়। মা মহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে চলে আসে। মহিলার কথার জবাব দেয় না। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলে, ফজলু তুমি আমাকে আমার মেয়ের কাছে নিয়ে যাও। ফজলু বুঝে যায় কোথায় যেতে হবে। ও মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে আসে।
মা ওর মাথার দিকে পুঁতে রাখা বাঁশের উপর হাত রেখে বলে, তুমি ভালো আছ তো? মেয়েটির কণ্ঠ, হ্যাঁ, ভালো
আছি। নানির সঙ্গে থাকি। তুমি তো জানো নানি ভীষণ যত্ন করে। যেখানে থাকি দারুণ সুন্দর জায়গা। চারদিক
ঝকঝকে, তকতকে। গাছে গাছে রং-বেরঙের ফুল ফুটে থাকে। ভোরবেলা পাখিগুলো কী সুন্দর গান যে গায়!
গান শুনে আমার ঘুম ভাঙে। আচ্ছা মা, আমাদের ঢাকা শহরটা এমন সুন্দর হয় না কেন?
মা চোখে আঁচল চাপা দেয়।
মেয়েটি আবার বলে, তোমরা আর কত দিন এই শহরের এইসব জঞ্জালের মধ্যে থাকবে?
মা মৃদু স্বরে বলে, যতদিন বেঁচে থাকতে হবে ততদিন।
মায়ের নাকে কামিনী ফুলের গন্ধ এসে লাগে। বাতাসের এক ঝাপটায় এক ঝলক গন্ধ। মা চারদিকে তাকায়।
শত শত কবর। সব কবরের গায়ে গজিয়ে উঠেছে হরেক রকম ফুলের গাছ। কত যে তার গন্ধ। মা বুক ভরে শ্বাস
টানে। মায়ের মনে হয়, স্বস্তি পাওয়ার জন্য এটাই এখন উপযুক্ত জায়গা। এখানে কালো ধোঁয়া নেই, বাতাসে সিসার গন্ধ নেই। এখানে এলে চমৎকার সময় কাটে। মাকে দেখলে ছুটে আসে শিশুরা। মা ওদের সঙ্গে কথা বলে। কেউ বলে, আগামী ঈদে আমাকে একটি জামা দেবেন কিন্তু। মা বলে, দেবো। ওরা খুশিতে উজ্জ্বল মুখে তাকায়। বলে, সবাইকে দেবেন?
-হ্যাঁ, সবাইকে।
ওরা মায়ের পিছে পিছে আসে। মা ওদের পয়সা দেয়। ওরা বলে, আমরা আপনার মেয়েকে রোজ ফুল দিয়ে যাব।
মা আনমনে বলে, ও ফুল ভীষণ ভালোবাসে। তোরা জানিস আমি বিদেশে গেলে ওর জন্য সুগন্ধি মোম কিনে আনি। ও খুব মোম ভালোবাসত।
ছেলেমেয়েরা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওরা মায়ের মেয়েটিকে চেনে না, তবু একজন বলে, আমি তাকে স্বপ্ন দেখেছি।
-সত্যি? কী দেখেছিস? কেমন দেখেছিস?
-পরি স্বপ্ন দেখেছি। কী সুন্দর পাখা মেলে আকাশে উড়ে বেড়ায়।
মায়ের দম বন্ধ হয়ে আসে। ওদের মাথায় হাত রাখে। ভাবে, ওরাই তাকে সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারে। মায়ের চোখে পানি দেখে ওরাও চোখ মোছে। শিশুদের আন্তরিকতায় মা অভিভূত হয়।
আরও দেখুন...